প্রকাশিত: ০১/১২/২০১৬ ৭:৪৮ এএম

বিশেষ প্রতিবেদক::

মায়ানমার থেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের ভেতরে টিন, বাঁশ, কাঠ ও পলিথিন দিয়ে ঘর নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। গাছপালা কেটে ও উঁচু জমি সমতল করে সেখানে শত শত ঘর নির্মাণকাজ চলছে। কেটে উজার করা হচ্ছে বন। স্থানীয়দের তত্ত্বাবধানে সেখানে ঘর তৈরি করে ভাড়া দেয়া হচ্ছে।

আবার টেকনাফের নাফ নদীতে নৌকায় আসা যেসব রোহিঙ্গা নৌকা বিজিবি পুশব্যাক করছে তারা কেউই মায়ানমারে ফিরে যাচ্ছে না। নদী দিয়ে অন্য পয়েন্টে গিয়ে তারা ঠিকই এপারে আসছে। এপারে আসা অনেক রোহিঙ্গা জড়াচ্ছে নানা অপরাধে।

অনেক সুন্দরী রোহিঙ্গার বিয়ে হচ্ছে এখানকার লোকজনের সঙ্গে। শনাক্ত করার উপায় না থাকায় এরা মিশে যাচ্ছে স্থানীয়দের সঙ্গে। ভোটার না হলেও রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে থাকা অনেকেই নিয়মিত যোগ দিচ্ছে সভা সমাবেশে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বুধবার সরজমিনে কুতুপালং অনিবন্ধিত শরাণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, শত শত ঘর নির্মাণকাজ চলছে। স্থানীয়দের সহায়তায় এসব ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। কোনোটি টিনের লম্বা কলোনি, আবার কোনোটা পলিথিন, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি। এসব ঘরের জন্য রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন পরিমাণ টাকা দিতে হয়।

আবার পরিশোধ করতে হয় মাসিক ভাড়াও। অনিবন্ধিত ক্যাম্পে এখন চলছে ঘর তৈরির হিড়িক। ক্যাম্পের ভেতরকার গাছপালা কেটে সমতল ভূমি তৈরি করে চলছে শত শত ঘর নির্মাণকাজ।

বুধবার দুপুরে দেখা গেছে স্থানীয় ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর মিয়ার নির্দেশে সেখানে টিনের কলোনি তৈরির পাশাপাশি সারি সারি কাঠ, বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে ঘর তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে ৮-১০ জন শ্রমিক। পুরো ক্যাম্পের ভেতরে এমন শত শত ঘর নির্মাণকাজ চলছে। গতকালও শতাধিক রোহিঙ্গা এই ক্যাম্পে নতুন করে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে।

উখিয়ার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) পার্থ প্রতিম দেব জানান, নাফ নদী থেকে রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করা হলেও তারা আরাকানে ফিরে যাচ্ছে না। রুট পাল্টে গোপনে তারা অন্য পয়েন্ট দিয়ে ঠিকই এপারে প্রবেশ করছে। দালালসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তারা অনুপ্রবেশ করে শরণার্থী ক্যাম্পে প্রবেশ করছে। সেখানে আগে থেকেই তাদের পরিচিত ও স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিচ্ছে।

তিনি বলেন, মূলত হতদরিদ্র রোহিঙ্গারা এদেশে আসছে সচ্ছলরা কম আসছে। এপারে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে তারা জনপ্রতি রেশন সুবিধা পায়। শিশু খাদ্যেরও ব্যবস্থা রয়েছে।

এপারে আসা রোহিঙ্গারা নানাবিধ অপরাধে জড়াচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, অনেক রোহিঙ্গা নারীর এপারে বিয়ে হচ্ছে। এতে তাদের আত্মীয়স্বজন তৈরি হচ্ছে। স্বামী পরিত্যক্তরাও বিয়ে করছেন এখানে এসে। এদের শনাক্ত করার সহজ উপায় না থাকার সুযোগ নিচ্ছে এরা। অনেকে তদবির করে শরণার্থী নিবন্ধন তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করে থাকে।

পার্থ বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে থানায় প্রতিনিয়ত অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেকেই ধরা পড়ে, আবার অনেককেই পাওয়া যায় না।

বুধবার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়া বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, রাজনৈতিক নেতাদের রোহিঙ্গাদের মিছিল মিটিংয়ে ব্যবহার করে থাকে। এরা ভোটার না হলেও সভা সমাবেশে যোগ দিয়ে থাকে। রোহিঙ্গা সর্দার (মাঝি) অন্য রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে এনজিওর মাধ্যমে প্রাপ্ত টাকা ও সুবিধা থেকে কমিশন নিয়ে থাকে।

স্থানীয়দের ছত্রছায়ায় থেকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ এমনকি হত্যাকাণ্ডে পর্যন্ত জড়াচ্ছে। এরা ক্যাম্পের ভেতরে ড্যারায় ঢুকে গেলে আটক করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। এরা সহজেই আত্মগোপন করতে পারে। মাঝিদের অনেকে নানা কায়দায় সম্পদের মালিক হয়েছেন। অনেকের আছে গাড়ি ও নিজস্ব ব্যবসা।

২৭ নভেম্বর কুতুপালং অনিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পে আসা রোহিঙ্গা আবুল ফয়েজ (৩০) জানান, তার বাড়ি মায়ানমারের নাইশাপুরীতে। এখানে এসে তিনি এক স্বজনের ড্যারায় আশ্রয় নিলেও এখন ৫০০ টাকা দিয়ে এক চিলতে জমিতে পলিথিন, বেড়া ও কাঠ দিয়ে ঘর নির্মাণ করে পরিবার নিয়ে থাকছেন।

অপর রোহিঙ্গা মো. আসাদ জানান, তার ছোট ভাই মো. নূর (১৮) ও বোন রেহেনা (১৬) সেখানকার সেনাবাহিনীর ও পুলিশের গুলিতে ১৮ নভেম্বর নিহত হয়েছে। তার বোনকে নির্যাতন করা হয়েছে। এরপর তিনি পরিবারের ৪ সদস্যকে নিয়ে এই ক্যাম্পে আসেন। স্থানীয় ফজর আলীক ৫০০ টাকা দিয়ে নির্মাণ করেছেন ড্যারা। নাইশাপুরী গ্রামের নূর হাসেম জানান, তাদের গ্রামের প্রায় দুই হাজার পরিবার গত ২০ দিনে এপারে এসেছে।

মঙ্গলবার মায়ানমারের হাঁড়িপাড়া থেকে এসেছেন হামিদা বানুু (৫৪)। সঙ্গে এসেছে পরিবারের ৫ সদস্য। হামিদা জানান, তার স্বামী নূর হোসেন, মেয়ে জান্নাতুল, জেসমিন আরা ও ইয়াসমিন আরাও এসেছে তার সঙ্গে। আরেক মেয়ে নূর বেগম ও নূর কদরকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধরে নেয়ার পর খবর মিলছে না। নূর বেগমের স্বামী ইসলাম আহমদকে ধরে নিয়ে গেছে সেখানকার পুলিশ।

হামিদা বলেন, সেনা সদস্যরা তাদের খাবার প্লেটে প্রসাব করে দিয়েছে। মহিলা ও শিশুদের নির্যাতন করছে। পুরুষদের হত্যা করছে। নির্যাতনের মাত্র দিন দিন বাড়ছে। ওপারে সবাই ভয়ের মধ্যে আছেন। এপারে আসার সুযোগ খুঁজছেন।

তেরিপাড়ার ইলিয়াস হোসেন বলেন, ৩ দিন আগে পরিবারসহ ১১ স্বজন নিয়ে এপারে এসেছি। এপারে একই গ্রামের ভাষা মিয়ার (কয়েক বছর আগে এসেছেন) ড্যারায় উঠেছি। সেখানে আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

কেয়ারিপাড়ার আলম বাহার জানান, ১০-১২ দিন আগে তিনি এলেও এখনো কোনো কাজ পাননি। লোডাইং গ্রামের রেজিয়া বেগম এসেছেন চার দিন আগে। তার স্বামীর নাম ইউসুফ মিয়া। রেজিয়া বলেন, মগরা (বিধর্মীদের মগ বলা হয়) আমাদের ওপর নির্যাতন করছে। কারণ ছাড়াই হঠাৎ হামলে পড়ছে। আরাকান রাজ্য এখন মগের মুল্লুক।

নিবন্ধিত ক্যাম্পের বাসিন্দা ইছাক খলিল বলেন, রোহিঙ্গা আসা কমবে না। বরং বাড়বে। তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। গাদাগাদি অবস্থায় নতুনদের জন্য ঘর তৈরি করা হচ্ছে। এজন্য যেমন কারো অনুমতির দরকার হয় না তেমনিভাবে এর খবরও কেউ নেয় না। এনজিওগুলো নতুনদের তালিকা করে খাবার ও চিকিৎসা সুবিধা দেয়।

অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশের মুখে স্থানীয় জাকির হোসেনের বাড়ি। তার মেয়ে রেশমী রোহিঙ্গাদের ওপর বেজায় ক্ষুদ্ধ। তিনি বলেন, ওরা খুবই খারাপ। নানা অপরাধে জড়িত। বন কেটে উজার করে ওরা ঘরবাড়ি বানাচ্ছে। কারো কথা ওরা শুনে না, কাউকে ভয় করে না। নিবন্ধনকৃতদের সূত্র ধরে নতুনরা আসছে। তিনি বলেন, ওরা ওপারে অভাবে আছে। এপারে থাকা খাওয়া যাবে এজন্য শিকড় ধরে ধরে ওরা আসছে। পরিবেশ নষ্ট করছে।

উখিয়ার কুতুপালং বাজারের চিকিৎসক আবদুল মজিদ বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যকার শতকরা ৭০ ভাগ এখন ব্যবসায়ী। এরা অপরাধেও জড়িত। অপরাধ করে এরা নিজেদের ক্যাম্পে ঢুকে পড়লে আর পাওয়া যায় না। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়া এলাকায় রাস্তার পাশে সরকারি জমি দখল করে এরা দোকানপাট নির্মাণ করে দিব্যি ব্যবসা করছে। এমনকি এরা সামাজিক বনায়ন ধ্বংস করে ঘরবাড়ি বানাচ্ছে।

সূত্র মতে, মঙ্গলবার রাতে মংডুর উত্তরে রাইম্যঘোনা এলাকায় নাফ নদীতে নৌকা দিয়ে পার হওয়ার সময় সেনাবাহিনীর গুলিতে ৯ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। সেনারা ১৫ জনকে ধরে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।

ঘুমধুম বিজিবি ক্যাম্পের সুবেদার সাইফুল ইসলাম বলেছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় কোনো রোহিঙ্গা ওই পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করেনি। কাউকে পুশব্যাকও করা হয়নি।সুত্র; কক্সবাংলা

পাঠকের মতামত